RED STONE
Leatest stories:

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

খুনের দায় (পর্ব -২)

ঠিক সাড়ে আটটায় ফিলিপ শেফার্সের বাড়ি থেকে ত্রিশ গজ দূরে রাস্তায় পার্ক করা তোবড়ানো টয়োটা সিপ্রণ্টারে এসে ঢুকল গিলটি মিয়া। নাস্তা করতে গিয়েছিল। ফিরে এসেছে দুই হাতে দুটো প্যাকেট নিয়ে। ছোট প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল ক্যাভিনের দিকে, ‘ল্যাও, ভাই, চারটে খেয়ে ল্যাও। তারপর নাববো আমরা কাজে। খেতে খেতে শোনাও দিকি গত একটা ঘণ্টায় কী দেকলে।’

কৃতজ্ঞচিত্তে ওস্তাদের আনা প্যাকেটটা খুলল ক্যাভিন। সুন্দর করে সাজানো রয়েছে সকালের নাস্তা: ম্যাকডোনাল্ডসের দুটো ক্লাব স্যাণ্ডউইচ, দুটো বার্গার, দুই পিস গ্রিল করা পুরু স্টেইক ও আলুভাজা। পাশে আলাদা একটা খোপে শোয়ানো আছে কোকের বোতল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শোনাল ক্যাভিন, ‘তেমন কিছুই ঘটেনি, ওস্তাদ। হুম-হাম হুম-হাম, কোঁৎ। সাড়ে সাতটায় দরজার সামনে দুধের বোতল রেখে গেছে মিল্ক-ভ্যান। সাতটা পঞ্চাশে সোনালি চুলো এক সুন্দরী ওটা তুলে নিয়ে গেছে ভেতরে।’

‘শেফার মিয়া কাজে যায়নি?’

‘ঢক-ঢক-ঢক, কেউ বেরোয়নি, কেউ ঢোকেনি, ওস্তাদ। ঘ্যাঁ—ও!’

মাথা ঝাঁকিয়ে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে বাড়িটার উপর চোখ বুলাল গিলটি মিয়া কিছুক্ষণ। ‘লে হালুয়া!’ ভাবছে সে, ‘হাতে বেশি সোমায় নেইকো। ও-বাড়িতে ঢুঁকতে হবে না? সায়েব-বিবি না বেরুলে পরে টেলিফোনে ছারপোকাটা রাকা তো কটিন হয়ে যাবে!’

ক্যাভিনের নাস্তা ও কোক শেষ হতেই ওর দিকে বাড়িয়ে দিল গিলটি মিয়া বড় প্যাকেটটা।

‘কী আছে এর ভেতর?’ জানতে চাইল সাগরেদ।

‘খুলেই দ্যাকো না,’ বলল গিলটি মিয়া। ‘তোমার বেশভুষো। ল্যাও, পরে ল্যাও এগুনো।’

প্যাকেটের ভিতর থেকে বের হলো টুলবেল্ট, ব্যাগ ও তোবড়ানো ক্যাপ সহ টেলিফোন মিস্ত্রির একটা আধময়লা ওভারল। ওগুলো পরা হয়ে যেতেই পকেট থেকে টু ব্রাশের মত একফালি গোঁফ বের করে সাঁটিয়ে দিল গিলটি মিয়া ক্যাভিনের নাকের নীচে। একটা লোমওয়ালা জড়ুল বসিয়ে দিল গালে, চোখের ঠিক নীচে।

‘দারুণ মানিয়েচে, মাইরি!’ বলল সে খুশি হয়ে। ‘এবার ধরো এই ছারপোকাটা। টেলিফোনের মদ্যে ঢুঁকিয়ে দিয়ে এসো, আমি বাকি কাজ সেরে রাকচি।’

ক্যাভিনকে বিদায় দিয়ে একটা ওয়ায়্যারলেস রিসিভার ফিট করল সে ভয়েস কণ্ট্রোল্‌ড্‌ রেকর্ডারের সঙ্গে। কথা শুরু হলেই চালু হয়ে যাবে টেপরেকর্ডার, কথা থেমে গেলে থামবে। সব রেডি হয়ে গেলে গাড়িটা শেফার্সদের বাড়ি থেকে একশো গজ দূরে নিয়ে গিয়ে রাখল রাস্তার অপর পাশে।

ওদিকে সোজা গিয়ে শেফার্সদের বাড়ির দরজায় কলিংবেল টিপল ক্যাভিন। দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে ছিটকিনি সরাল কেউ। দরজার ফাঁক দিয়ে গোলাপি হাউসকোট পরা সেই সুন্দরী মেয়েটিকে দেখা গেল। আর কাউকে আশা করেছিল হয়তো, ওকে দেখে হতাশা ফুটল চোখেমুখে। একনজরে বোঝা গেল, খুবই উৎকণ্ঠায় রয়েছে মেয়েটি, চোখের নীচের কালচে দাগ বলে দিচ্ছে, রাতে ঘুমাচ্ছেও কম। হাতের নোটবইয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল ক্যাভিন, ‘মিসেস ফিলিপ শেফার্স?’ ‘হ্যাঁ, আমি মিসেস শেফার্স।’

‘কোড এরিয়া ফোন লাইনে একটা হামিং সাউণ্ড আসছে, ম্যাম। কোথায় শর্ট হয়ে আছে লাইন দেখতে এসেছি।’ নিজেকে টেলিফোন কোম্পানির লোক বলে মিথ্যে পরিচয় না দিয়ে জানতে চাইল, ‘টেলিফোনটা কোথায়, ম্যাম?’

‘আমার ফোন ঠিক আছে।’

‘ইয়েস, ম্যাম,’ হাসিমুখে নরম গলায় বলল ও, ‘তবে আপনার লাইনে যদি কোনও শর্ট থাকে তা হলে আর সব সার্কিটে গোলমালের সৃষ্টি করবে। চেক করতে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড লাগবে আমার।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আসুন।’

লিভিংরুমটা অত্যন্ত সাদামাটা আসবাবে সাজানো। প্র মেই রিসিভার তুলে অপারেটরের সঙ্গে কথা বলার ভান করল ক্যাভিন। তারপর রিসিভারের সঙঊু খুলে মহিলার চোখের সামনেই ছোট্ট মাইক্রোসার্কিট ট্র্যান্সমিটারটা ফিট করল জায়গা মত। এগুলো ছোট হলে কী হবে, টেলিফোনে বলা প্রতিটা শব্দ পৌঁছে দেবে দুশ’ গজ দূরের রিসিভারে। কাজ হয়ে যেতেই রিসিভারটা জোড়া লাগিয়ে ক্রেড্‌লে্‌ টিপে ছেড়ে দিয়ে ডায়াল টোন চেক করল, তারপর বলল, ‘আপনার ফোন ঠিকই আছে, মিসেস শেফার্স। তবু বাড়তি সতর্কতা হিসেবে দুর্বল এক-আধটা পার্টস বদলে দিলাম। অনেক ধন্যবাদ, ম্যাম।’

গাড়িতে ফিরে এসে ছদ্মবেশ খুলে ফেলল ক্যাভিন হাওয়ার্ড। মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল ওস্তাদকে, কাজ হয়ে গেছে। গিলটি মিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়িতে আর কাউকে দেকলে?’

‘নাহ্‌, কাউকে দেখিনি। মনে হলো মেয়েটা কারও অপেক্ষায় আছে, খুব দুশ্চিন্তায়। এবার, ওস্তাদ?’

‘এবার একটু ঘুরে-ফিরে এসো বাইরে থেকে। আদঘণ্টা পর পাবলিক ফোনবুত থেকে কতা বলবে তুমি মেয়েটার সাতে।’ কী কথা বলতে হবে ক্যাভিনকে শিখিয়ে দিল গিলটি মিয়া।

আধঘণ্টা পর শেফার্সদের নম্বরে রিং দিল ক্যাভিন। মেয়েটি রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই গলাটা ভারী করে বলল, ‘মিসেস শেফার্স, আমি রবার্ট স্ট্যানলির একজন শুভাকাঙক্ষী, বন্ধু। আপনি কি…’

‘রং নাম্বারে কল করেছেন!’ বলেই খটাং করে নামিয়ে রাখল মেয়েটি রিসিভার।

আবার ডায়াল করল ক্যাভিন। পাঁচ-ছয়বার বাজার পর রিসিভার তুলল মেয়েটি, ‘ইয়েস?’

‘মিসেস শেফার্স, আমি কী বলি না শুনেই রিসিভার নামিয়ে রাখবেন না। আমি জানি, প্লেনক্রাশের পর আপনি রবার্ট স্ট্যানলিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছেন। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বড় অঙ্কের টাকা ওঁর হাতে তুলে দিতে চাই। আপনি যদি…’

‘আমি একবার আপনাকে বলেছি: ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছেন আপনি! রবার্ট কী যেন বললেন, ওই নামের কাউকে চিনি না আমি। দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না!’ বলেই আবার আছড়ে রাখল মহিলা রিসিভার।

ক্যাভিনের মনে হলো, হিস্টিরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে মেয়েটির আচরণে। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করবার প্রয়োজন হলো না, ওয়ায়্যারলেস রিসিভারের কল্যাণে সবই শুনেছে গিলটি মিয়া। বরং সে-ই শোনাল নতুন খবর।

‘তোমার দুইলম্বর কল পাওয়ার আদ মিলিটের মদ্যেই পোটল্যান হোটেলের ২৩২ লম্বর কামরায় মিশটার ব্রেনান বলে একজনের সাতে কতা বলেচে মেয়েটা। বোধায় ওই নামেই ওখেনে উটেছে ইস্ট্যানলি। থত্থর করে কাঁপচে গলা, তোমার সাতে কী কতা হলো সব জানাল মেয়েটা ওকে। নিজ কানে শুনে দ্যাকো।’

রেকর্ডার রিওয়াইণ্ড করে চালিয়ে দিল গিলটি মিয়া।

‘শান্ত হও, রিটা। একটুও ঘাবড়িয়ো না তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে। লোকটা আবার যদি ফোন করে, তুমি সাফ বলে দেবে ওর একটা কথাও বুঝতে পারছ না। আচ্ছা, রিটা, কয়েকটা দিন তোমার মায়ের কাছে গিয়ে থাকো না। ঝামেলা সামলে নিয়েই আমি ডেকে পাঠাব তোমাকে।’

‘ওখানে গিয়ে নাটক করতে পারব না আমি। অসম্ভব। এমনিতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে আমার। বিশ্বাস করো, দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছি… স্রেফ পাগল হবার দশা!’

‘শান্ত থাকার চেষ্টা করো, হানি। এক কাজ করো, টেলিফোন এলে ধোরো না। কিংবা… তার চেয়ে ভাল হয়, চলে এসো আমার এখানে।’

‘কিন্তু মা যদি ফোন করে দেখে কেউ ধরছে না, তা হলে কী তুলকালাম কাণ্ড বাধাবে কে জানে! হয়তো… উফ্‌! মনে হচ্ছে ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছি আমি!’

‘রিটা, মাথা ঠাণ্ডা রাখো, লক্ষ্মীটি। এখন পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক মত চলছে। আমার কথা শোনো: তোমার ঘনিষ্ঠজনদের ফোন করে জানিয়ে দাও, দিন কয়েকের জন্যে অন্য কোথাও যাচ্ছ তুমি, বলবে: এ-বাড়িতে একা থাকতে গা ছমছম করছে তোমার, চমকে চমকে উঠছ, এইসব আরকী। তারপর চলে এসো আমার কাছে। দুপুর দুটোর মধ্যে পৌঁছে যাবার চেষ্টা কোরো। কোনও ভয় নেই, কোনও বিপদ হবে না-নিজেকে শান্ত রাখতে পারলে দেখবে কয়েকদিনেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে সব। তা হলে রাখি এখন… দেখা হচ্ছে দুটোয়, ছাড়লাম।’

‘বাহ্‌! একেবারে পরিষ্কার রেকর্ডিং!’ হাসল ক্যাভিন। ‘এখন আমরা কী করব, ওস্তাদ?’

‘সেইটে জানতেই একবার আপিসে যেতে হবে আমাদের,’ বলল গিলটি মিয়া। ‘রেকর্ডারটা অটোতে সেট করাই আচে। এই ক্যাসেট খুলে আরাকটা ফিট করে দিচ্চি, তুমি গাড়িটা লিয়ে গিয়ে ও-বাড়ির কাচাকাচি পার্ক করে ইঞ্জিলের বনেট খুলে এটা- ওটা ঘাঁটো, তারপর দরজা-জানলা লক করে চলে এসো আমার কাচে। আমরা প্রত্থমে উ-ই ওষুদের দোকানে যাব, তারপর আপিসে।’

ওষুধের দোকানে ফোনবুক ঘেঁটে জানা গেল, পোর্টল্যাণ্ড হোটেলটা ব্রুকলিনে।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে এল ওরা অফিসে। দেখল, দুই পা টেবিলের উপর তুলে দিয়ে এক হাতে কফির কাপ, অপর হাতে একটা ফাইল ধরে রেখে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রয়েছে মাসুদ রানা। ওদের দেখে সোজা হয়ে বসল।

চুপচাপ শুনল রানা আদ্যোপান্ত সব। দু’বার বাজিয়ে শুনল টেলিফোনের আলাপ।

‘এবার?’ জিজ্ঞেস করল ও, ‘এবার কী করবে ভাবছ?’

‘অ্যাকোন ওই আদম ব্যাপারী, থুড়ি, আদম কিলিপটন সায়েবকে ঠিকানাটা জানিয়ে দিলেই আমাদের কাজ শেষ।’ মাথা নাড়ল রানা।

‘তার আগে জানতে হবে এই লোক সত্যিই রবার্ট স্ট্যানলি কি না। আর যদি স্ট্যানলিই হয়, পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন, কীসের ভয়ে। রিটা শেফার্সের সঙ্গেই বা তার কী সম্পর্ক। তা-ই না?’

‘ঠিক বলেচেন, সার!’ একযোগে মাথা ঝাঁকাল ক্যাভিন ও গিলটি মিয়া।

রানা বলল, ‘চলো, আমিও যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে।’

মাঝারি মানের হোটেল, তবে নতুন। ছোকরা ঘাবড়ে যেতে পারে ভেবে গিলটি মিয়া আর ক্যাভিন হাওয়ার্ডকে নীচের ফয়ে- তে অপেক্ষা করতে বলে উঠে এসেছে রানা তেতলায়। টোকা দিতেই খুলে গেল ২৩২ নম্বর কামরার দরজা। জিন্সের প্যাণ্ট আর হালকা নীল, বুক-খোলা শার্ট পরা লম্বা এক লোককে দেখা গেল দরজার ওপাশে। চেহারা হুবহু মিলে যায় নার্সদের বর্ণনার সঙ্গে। অপরিচিত লোক দেখে কুঁচকে গেল ভুরু। বলল, ‘সিধে রাস্তা মাপো, মিস্টার। কিছু কেনার মুডে নেই আমি এখন।’ কথাগুলোর সঙ্গে ভেসে এল সস্তা হুইস্কির গন্ধ। দরজাটা বন্ধ করে দেবার আগেই জুতো পরা পা ঢুকিয়ে দিল রানা কপাটের ফাঁকে, তারপর বের করে দেখাল রানা এজেন্সির ইনভেস্টিগেশন লাইসেন্স।

‘আপনার সঙ্গে কথা আছে, মিস্টার স্ট্যানলি।’

নামটা শুনে একটু বড় হলো চোখ, কার্ডটা খুঁটিয়ে দেখে নাক কোঁচকাল স্ট্যানলি। ‘ও, প্রাইভেট টিকটিকি! ভাল চান তো কেটে পড়ুন, নইলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।’

‘ডাকুন না,’ অমায়িক হাসি হাসল রানা। ‘আপনি কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু না জেনেই বিরূপ আচরণ করছেন। আমি এসেছি আপনাকে ত্রিশ হাজার ডলার পাইয়ে দিতে। এ ব্যাপারে কিছু শুনতে কি আপনি বিরক্তি বোধ করবেন? নিশ্চয়ই না?’

‘ঠিক আছে, বলুন কী বলার আছে আপনার।’ রানার জুতোটা লক্ষ করছে সে বাঁকা চোখে।

‘করিডোরে দাঁড়িয়ে?’

‘হ্যাঁ। যা বলবার এখানে দাঁড়িয়েই বলুন। বেশি সময় দিতে পারব না। আপনাকে উকিল ক্লিপটন আমার পেছনে লাগিয়েছে, তাই না?’

‘ঠিক ধরেছেন। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না কেন? উইল মোতাবেক বণ্টন-নিষ্পত্তির জন্যে খুঁজছেন তিনি আপনাকে, ধরে খেয়ে নেবার জন্যে নয়।’

‘যখন ইচ্ছে হবে, আমি নিজেই দেখা করব। আপনি গিয়ে ওকে বলুন, পেছনে টিকটিকি লাগিয়ে আমাকে উত্ত্যক্ত করার কোনও দরকার নেই। ওর আচরণ মোটেই পছন্দ হচ্ছে না আমার।’

এক হাত উঁচু করে চুল ঠিক করল স্ট্যানলি। আঙুলের ফোলা গিঁঠগুলো দেখে ওটাকে শিল্পীর হাত মনে হলো না রানার, মনে হলো কোনও বক্সারের হাত। নরম গলায় বলল, ‘টাকাগুলো নিতেই আটলাণ্টিক পাড়ি দিয়ে এসেছেন আপনি আমেরিকায়। তা হলে কি ধরে নেব, আপনার প্রাপ্য ত্রিশ হাজার ডলারে আপনার আর আগ্রহ নেই?’

‘ঠিক জানি না,’ যেন খুব চিন্তায় পড়ে গেছে এমনি ভঙ্গিতে বলল স্ট্যানলি। ‘এ-টাকা পাওয়া মাত্র একলাফে আমার ইনকাম চলে যাবে উঁচু ট্যাক্স-ব্র্যাকেটে। ট্যাক্স বেড়ে যাবে অনেক। কে জানে, আখেরে হয়তো ক্ষতিই হবে। ভাবছি, নিসে ফেরত যাওয়াই হয়তো আমার জন্যে ভাল হবে।’

‘ক্লিপটনকে ফোন করে একথা জানিয়ে দেননি কেন?’

‘ইচ্ছে হয়নি, তাই।’ বলেই সিধে হয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল স্ট্যানলি। ‘এবার পা-টা সরিয়ে নিয়ে কেটে পড়ুন, মিস্টার। আর একটা কথা বললে এক ঘুসিতে নাকটা ফাটিয়ে দেব!’ হাসল রানা। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ভাই। অত চটে যাওয়ার মত কিছু হয়নি।’ হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। ‘আমরা হাসিমুখেই বিদায় নিতে পারি।’

সুযোগটা হাতছাড়া করল না বদমেজাজি যুবক। খপ্‌ করে ধরল রানার হাত। ধরেই গায়ের জোরে চাপ দিল, মুখে শায়েস্তা করার হাসি। হাসল রানাও। তারপর ও যখন পাল্টা চাপ দিতে শুরু করল, প্র মে বিস্ময় ফুটল শিল্পীর চোখে, তারপর মলিন হয়ে গেল হাসি। রানা আর একটু চাপ বাড়াতেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা, ঘাম দেখা দিল কপালে। ফরসা মুখটা যখন ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে, তখন ওর হাত একটু ঝাঁকিয়ে দিয়ে পা সরিয়ে নিল রানা দরজার ফাঁক থেকে। নিজের হাতটা চিত করে দেখল স্ট্যানলি আঙুল পাঁচটাই আছে কি না, তারপর দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজা।

নীচে নেমে ফয়ে থেকে অ্যাডাম ক্লিপটনকে টেলিফোন করল রানা। স্ট্যানলির ছদ্মনাম ও ঠিকানাটা জানাল তাকে, তারপর বলল, ‘মনে হচ্ছে, টাকাটার ব্যাপারে তেমন কোনও আগ্রহ নেই ওর মধ্যে। নিসে ফিরে যাওয়ার কথাও একবার উচ্চারণ করল।’ ‘তা হলে এখানে এসেছে কী করতে?’

‘সেটা আপনিই জিজ্ঞেস করুন ওকে। আমাদেরকে ওর পেছনে লাগানোয় রেগে গেছে লোকটা। আমার মনে হচ্ছে, কী এক কারণে যেন পালাই পালাই করছে, ওকে ধরতে হলে উড়ে চলে আসতে হবে আপনার এখানে।’

‘আচ্ছা,’ বলল ক্লিপটন। ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার রানা। চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন। আপনাদের কাজ শেষ, আর কোনও সাহায্য দরকার হবে না আমার। …রাখলাম।’

‘দাঁড়ান, এক সেকেণ্ড,’ বলল রানা। ‘আমাদের ধারণা, স্ট্যানলি এখন হোটেল বদলাবে। এক্ষুনি না এলে ওর দেখা পাবেন না।’

‘ঠিক আছে। আপনাদের পছন্দ করছে না যখন, এখন থেকে যা করার আমি নিজে করব, আপনাদের দায়িত্ব শেষ। ধন্যবাদ।’ কানেকশন কেটে দিল অ্যাডাম ক্লিপটন। চিন্তিত ভঙ্গিতে জুলফির নীচটা চুলকাল রানা। তারপর গিলটি মিয়া ও ক্যাভিনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে তেতলায় যা-যা ঘটেছে সব বলল।

‘আমার সন্দো হচ্চে, সার, সব একোনও শেষ হোইনিকো।’ ‘ঠিক বলেছ,’ বলল রানা। ‘তোমাদের এখন ওই ট্র্যান্সমিটারটা উদ্ধার করতে হবে শেফার্সদের টেলিফোন থেকে। তা নইলে ওটা পুলিশ বা টেলিফোন কোম্পানির কারও চোখে পড়লে আজ হোক বা কাল, মস্ত ঝামেলায় জড়িয়ে যাবে রানা এজেন্সি।’

‘মেয়েটা বেরিয়ে গেলেই ওটা খুলে লিয়ে আসব, সার।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘দিনে-দুপুরে ও-বাড়িতে ঢোকা খুবই রিস্কি হবে। চারপাশে অনেক লোক, অনেক বাড়িঘর। আবার একবার টেলিফোন মিস্ত্রীও সাজা যাবে না। কাজটা সারতে হবে তোমাদের সন্ধের পর।’

তবে অফিসে ফেরার পথে পিজিয়ন লেন হয়ে এলো ওরা। ক্যাভিনের তোবড়ানো টয়োটা সিপ্রণ্টার সামান্য কাত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার ধারে। মোড় ঘুরেই দাঁড় করালো রানা গাড়ি, একটা কাগজে লিখল: গাড়িটা বিকল, মেকানিকের অপেক্ষায় দাঁড়ানো, তারপর ক্যাভিনকে বলল, ‘এটা সাঁটিয়ে দিয়ে এসো ওটার উইণ্ডশিল্ডে।’

অফিসে ফিরে গিলটি মিয়া তার লোকজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাজে। রানা ঢুকল গিয়ে নিজের অফিস কামরায়। পিওন ছুটল সবার জন্য লাঞ্চ আনতে।

প্রথমেই ফোন করল রানা ক্রেডিট রেটিং অফিসে ওর বন্ধুর কাছে। বন্ধু জানাল: শেফার্সরা দুজন মিলে বছরে আয় করে এগারো হাজার দুইশ’ ডলার। বিশ হাজার দিয়ে কিনেছে ওরা বাড়িটা চার বছর আগে, পনেরো হাজার ডলার শোধ হবে ইন্সটলমেণ্টে আগামী পনেরো বছরে। বাড়ির আসবাবও কেনা হয়েছে ইন্সটলমেণ্টে। টাকা পরিশোধে কোনও গড়িমসি বা অনিয়ম নেই। মেয়েটা টাইপিস্টের কাজ করে একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে, ফিলিপ শেফার্স ট্রান্স-আটলাণ্টিক এয়ারলাইন্সের রিজার্ভেশন ক্লার্ক।’

‘এদেরই একটা প্লেন কদিন আগে ক্রাশ করেছে না?’

‘হ্যাঁ। ফিলিপ শেফার্স মারা গেছে ওই প্লেনক্রাশে। আর কিছু জানতে চাস, দোস্ত?’

‘না রে, তোকে ধন্যবাদ,’ খুব ধীরে উচ্চারণ করল রানা শব্দ ক’টা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন